ছয় দফা কর্মসূচি:
১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় জাতীয় সংহতি সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও প্রতিরক্ষার দাবি সংবলিত একটি কর্মসূচি ঘোষণা করেন। ইতিহাসে এটি ৬ দফা কর্মসূচির নামে পরিচিত।
(১) ৬ দফার ঘোষক → শেখ মুজিবুর রহমান।
(২) ৬ দফা ঘোষিত হয় → ৫ ফ্রেবুয়ারি,১৯৬৬,লাহোরে।
(৩) বঙ্গবন্ধু আনুষ্ঠানিকভাবে ৬ দফা ঘোষণা করেন → ২৩ মার্চ, ১৯৬৬ সালে।
(৪) স্বাধীনতার প্রথম সনদ → ৬ দফা।
(৫) আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে ৬ দফা গৃহীত হয় → ১৮ মার্চ, ১৯৬৬ সালে।
(৬) ৬ দফা রচিত হয়েছিল → লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে।
(৮) ৬ দফার পক্ষে জনমত গড়ে তুলে → ইত্তেফাক পত্রিকা।
(৯) ৬ দফা আন্দোলনের প্রথম শহিদ → মনু মিয়া,সিলেট।
(১০) ৬ দফা আন্দোলনে শাহাদত বরণ করেন → মনু মিয়া, মুজিবুল হক, শফিক ও শামসুল হকসহ ১১ জন বাঙালি শহিদ হন।
(১১) ৬ দফার প্রথম দাবি ছিল → প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন।
(১২) ৬ দফার শেষ দাবি ছিল → সেনাবাহিনী গঠনের দাবি।
(১৩) ঐতিহাসিক ৬ দফা দিবস → ৭ জুন।
(১৪) ৬ দফা কর্মসূচি → বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ বা ‘ম্যাগনা কার্টা’।
(১৫) বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য ৬ দফা ছিল → ‘ম্যাগনা কার্টা’।
(১৬) বঙ্গবন্ধু ৬ দফা কর্মসূচিকে → বাঙালির বাঁচার দাবি হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
(১৭) ঐতিহাসিক ৬ দফাকে তুলনা করা হয় → ম্যাগনা কার্টার সাথে।
(১৮) ৬ দফাকে কেন্দ্র করে নির্মিত চলচ্চিত্র → জয়বাংলা, পরিচালক ফখরুল আলম,মুক্তি পায় ১৯৭২ সালের ২৬ জানুয়ারি।
(১৯) ছয় দফা দাবি প্রণয়ন করেছিলেন → বঙ্গবন্ধু নিজেই।
(২০) ৬ দফা দাবি প্রথম উত্থাপন করা হয় → লাহোরে।
(২১) ৬ দফার অর্থনীতি বিষয়ক দফা ছিল → ৩ টি।
(২২) ছয়দফা সংক্রান্ত পুস্তিকাটির নাম → ‘ছয় দফাঃ আমাদের বাঁচার দাবি।’
(২৩) ৬ দফার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্য হলো → বাঙালি জাতীয়তাবাদের ধারণার বিকাশ।
(২৪) ৬ দফা কর্মসূচি মূলত → অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মুক্তির কর্মসূচি।
(২৫) আওয়ামী লীগের ৬ দফা পেশ করা হয়েছিল →১৯৬৬ সালে।
(২৭) আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক ‘ছয় দফার’ প্রথম দফাতে ছিল → সংসদীয় গণতন্ত্র।
(২৮) ঐতিহাসিক ‘ছয় দফায়’ অন্তর্ভুক্ত ছিল না → বিচার ব্যবস্থা।
(২৯) ছয় দফাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন → ১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৬ সালে।[ লাহোর থেকে স্বদেশ ফিরে বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের সামনে ]
(৩০) ছয় দফা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হয় → ৮ মে ১৯৬৬ সালে।
(৩১) পূর্ববাংলা থেকে বঙ্গবন্ধুর ছয় দফার বিরোধিতা করেছিল → ফরিদ আহমদ।
(৩২) ছয় দফা আন্দোলন সমাপ্ত হয় → ২৫ মার্চ ১৯৭১ সালে।
(৩৩) ছয় দফা উত্থাপনের সময় বঙ্গবন্ধু চাকরি করতেন → আলফা ইন্সুরেন্সে।
(৩৪) ছয় দফা আন্দোলনের জন্য বঙ্গবন্ধু মোট → আটবার গ্রেপ্তার হন।
(৩৫) টাঙ্গাইলের বঙ্গবন্ধু টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে → ছয় দফা চত্বর অবস্থিত।
(৩৬) ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বরের নির্বাচনে ইশতেহার ছিল → ৬ দফা।
(৩৭) স্বাধীনতা সংগ্রামের বীজমন্ত্র বা অঙ্কুর ছিল → ছয় দফা।
(৩৮) ছয় দফা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর উক্তি → “সাঁকো দিলাম, স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতায় উন্নীত হওয়ার জন্য”
(৩৯) ছয় দফা বাঙালির → ‘স্বাধীনতার সনদ’
(৪০) ছয় দফা ঘোষণার পাঁচ বছর পর → বাংলাদেশের জন্ম হয়।
(৪১) ১৯৬৬সালের ছয় দফা ১৯৭১ সালে এসে → এক দফা তে পরিণত হয়।
(৪২) ঐতিহাসিক ছয় দফা ঘোষণা করা হয় ১৯৬৬ সালের → ফেব্রুয়ারি মাসে।
(৪৩) ছয়দফা রচিত হয় → সিমলা চুক্তির আলোকে লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে।
(৪৪) বঙ্গবন্ধু ছয়দফা লাহোরের সংবাদ সম্মেলনে উপস্থাপন করেন → ১৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৬ ।
(৪৫) বঙ্গবন্ধু ছয়দফাকে আখ্যায়িত করেন → ‘আমাদের বাঁচার দাবি’ বলে।
(৪৬) বঙ্গবন্ধুর কোটের ছয়টি বোতাম ছিল→ ছয়দফার প্রতীক।
(৪৭) বঙ্গবন্ধু উপাধি দেয়া হয় → ৬ দফার জন্য।
(৪৮) ঐতিহাসিক ‘ছয়-দফা’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেন → ২৩ মার্চ ১৯৬৬ সালে।
(৪৯) ‘আমাদের বাঁচার দাবি ৬-দফা কর্মসূচি’ পুস্তিকাটির লেখক → বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
(৫০) চট্টগ্রামের লালদীঘির ময়দানে ১৯৬৬ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি ছয় দফা আন্দোলনের → প্রথম জনসভা হয়েছিল।
(৫১) আপামর জনতার সামনে প্রথম সমাবেশ করে ছয় দফা দাবির ঘোষণা দেন → চট্টগ্রামের লালদীঘির ময়দানে। (১৯৬৬ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি)
(৫২) ১৯৬৬ সালে ছয় দফা দিয়েছিলেন বলেই ৫ বছরের মাথায় → একাত্তরে দেশ স্বাধীন হয়েছিল।
★★ ছয় দফা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় আসে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ১১ দফা আন্দোলন, ’৬৯’র গণঅভ্যুত্থান, ’৭০’র নির্বাচন, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং সর্বশেষ বিশ্ব মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয়।
★★ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি তাসখন্দ চুক্তিকে কেন্দ্র করে লাহোরে অনুষ্ঠিত সম্মেলনের সাবজেক্ট কমিটিতে ছয় দফা উত্থাপন করেন।
ছয় দফার পটভূমি:
জনসংখ্যা ও কৃষি সম্পদ পূর্ব বাংলায় বেশি থাকা সত্ত্বেও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার কিছুদিনের মধ্যেই রাজনৈতিক ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। পশ্চিম পাকিস্তানি নেতারা নানা কৌশল ও ছল-চাতুরীর মাধ্যমে দেশের মূল নেতৃত্ব নিজেদের কবজায় নেন। একই সঙ্গে শুরু হয় অর্থনৈতিক শোষণ ও বৈষম্য।
পূর্ব পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী থাকলেও, দুই ভাগে বিভক্ত দেশটিতে পশ্চিম পাকিস্তান অর্থনৈতিকভাবেও আধিপত্য বিস্তার করছিল। জনসংখ্যা কম হওয়া সত্ত্বেও পশ্চিম পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের সিংহভাগ বরাদ্দ পাচ্ছিল। পূর্ব বাংলা অর্থনৈতিকভাবে আগে থেকেই অনগ্রসর ছিল। পশ্চিম পাকিস্তানে কেন্দ্রীয় সরকারের অধিক বরাদ্দে এই অনগ্রসরতা আরও বৃদ্ধি পায়। পশ্চিম পাকিস্তানে অভিবাসী ব্যবসায়ীদের সংখ্যাধিক্যের কারণে পাকিস্তান রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা পশ্চিম পাকিস্তানেই কেন্দ্রীভূত হয়। ১৯৬০ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের মোট রপ্তানি আয়ের ৭০ ভাগ এসেছিল পূর্ব পাকিস্তানের রপ্তানি থেকে। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তান এই অর্থের মাত্র ২৫ ভাগ বরাদ্দ পেয়েছিল।
১৯৫৯ সালে পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচনের সময় নির্ধারিত হলে পাকিস্তানি কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠী নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। এই প্রেক্ষাপটে ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি হয়। মাওলানা ভাসানী ও বঙ্গবন্ধুসহ অনেক বাঙালি নেতা গ্রেপ্তার হন। ১৯৬২ সালে সামরিক আইন প্রত্যাহার করা হলে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র সমাজ ফের আন্দোলনে নামে। তথাকথিত শিক্ষা নীতিকে কেন্দ্র করে ১৯৬৩ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর এই আন্দোলন আরও বেগবান হয়।
১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বরে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ১৭ দিনের এই যুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তান অরক্ষিত ছিল। এ দেশের মানুষ উপলব্ধি করেন পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকেরা পূর্ব পাকিস্তানের নিরাপত্তা বিধানে কিছুই করেনি। এরপর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা কর্মসূচি ঘোষণা করলে পশ্চিম পাকিস্তানে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীকে এ কর্মসূচি শঙ্কিত করে তোলে। আইয়ুব খান নিজেও ছয় দফাকে বিচ্ছিন্নতাবাদী, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী, ধ্বংসাত্মক, বৃহত্তর বাংলা প্রতিষ্ঠার কর্মসূচি ইত্যাদি আখ্যায়িত করেন। তিনি শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানের এক নম্বর দুশমন হিসেবে চিহ্নিত করে ছয় দফাপন্থীদের দমনে অস্ত্রের ভাষা প্রয়োগের হুমকি দেন। এমনকি পূর্ব পাকিস্তানেও অনেকে ছয় দফার সমালোচনা করতে থাকেন। বঙ্গবন্ধু প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের হুমকিতে দমে যাননি।
ঐতিহাসিক ছয় দফার দাবিসমূহ:
দফা-০১: শাসনতান্ত্রিক কাঠামো ও রাষ্ট্রের প্রকৃতি:
পাকিস্তান হবে একটি যুক্তরাষ্ট্র। এর ভিত্তি হবে লাহোর প্রস্তাব। এর প্রদেশসমূহকে পূর্ণ প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে, যেখানে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার থাকবে এবং প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকদের ভোটের মাধ্যমে সার্বভৌম আইনসভা গঠিত হবে।
দফা-০২: কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা:
কেন্দ্রীয় (ফেডারেল) সরকারের ক্ষমতা থাকবে শুধু দুটি ক্ষেত্রে, যথা- দেশরক্ষা ও বৈদেশিক নীতি। অবশিষ্ট সকল বিষয়ে অঙ্গ-রাষ্ট্রগুলির ক্ষমতা থাকবে নিরঙ্কুশ।
দফা-০৩: মুদ্রা বা অর্থ-সম্বন্ধীয় ক্ষমতা:
মুদ্রার ব্যাপারে নিম্নলিখিত দু’টির যে কোন একটি প্রস্তাব গ্রহণ করা যেতে পারেঃ-
(ক) সমগ্র দেশের জন্যে দু’টি পৃথক, অথচ অবাধে বিনিময়যোগ্য মুদ্রা চালু থাকবে। অথবা
(খ) সমগ্র দেশে একটি মুদ্রা থাকবে তবে সেক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে মূলধন পাচার বন্ধ করার কার্যকর ব্যবস্থা থাকতে হবে। এজন্য স্টেট ব্যাংকের অধীনে ২ অঞ্চলে দুটি রিজার্ভ ব্যাংক থাকবে।
দফা-০৪: রাজস্ব কর ও শুল্ক বিষয়ক ক্ষমতা:
প্রদেশগুলোর কর নির্ধারণের সার্বভৌম ক্ষমতা থাকবে।কেন্দ্রীয় সরকারের কোনরূপ কর ধার্যের ক্ষমতা থাকবে না। তবে প্রয়োজনীয় ব্যয় নির্বাহের জন্য অঙ্গ-রাষ্ট্রীয় রাজস্বের একটি অংশ কেন্দ্রীয় সরকারের প্রাপ্য হবে।
দফা-০৫: বৈদেশিক বাণিজ্য বিষয়ক ক্ষমতা:
(ক) ফেডারেশনভুক্ত প্রতিটি রাজ্যের বহির্বাণিজ্যের পৃথক পৃথক হিসাব রক্ষা করতে হবে।
(খ) বহির্বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা অঙ্গরাজ্যগুলির এখতিয়ারাধীন থাকবে।
(গ) কেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা সমান হারে অথবা সর্বসম্মত কোন হারে অঙ্গরাষ্ট্রগুলিই মিটাবে।
(ঘ) অঙ্গ-রাষ্ট্রগুলির মধ্যে দেশজ দ্রব্য চলাচলের ক্ষেত্রে শুল্ক বা করজাতীয় কোন রকম বাধা-নিষেধ থাকবে না।
(ঙ) শাসনতন্ত্রে অঙ্গরাষ্ট্রগুলিকে বিদেশে নিজ নিজ বাণিজ্যিক প্রতিনিধি প্রেরণ এবং স্ব-স্বার্থে বাণিজ্যিক চুক্তি সম্পাদনের ক্ষমতা দিতে হবে।
দফা-০৬: আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠনের ক্ষমতা:
আঞ্চলিক সংহতি ও শাসনতন্ত্র রক্ষার জন্য শাসনতন্ত্রে অঙ্গ-রাষ্ট্রগুলিকে স্বীয় কর্তৃত্বাধীনে আধা সামরিক বা আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠন ও রাখার ক্ষমতা দিতে হবে।