একনজরে ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ

(১) ৭ই মার্চ ভাষণের প্রথম কথা → “ভায়েরা আমার, আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি….।”

(২) ৭ই মার্চ ভাষণের শেষকথা → “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা। ”

(৩) ৭ই মার্চ ভাষণের মূল বক্তব্য ছিল → স্বাধীনতা সংগ্রাম তথা মুক্তি সংগ্রামের ঘােষণা (পরােক্ষভাবে)।

(৪) ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু ৪ দফা দাবি পেশ করেন → ১. সামরিক আইন প্রত্যাহার ২. সৈন্যদের ব্যারাকে ফিরিয়ে নেয়া ৩. গণহত্যার তদন্ত করা  ৪. নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা।

(৫) বঙ্গবন্ধুর ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণের সময়কালে পূর্ব পাকিস্তানে চলছিল→ অসহযােগ আন্দোলন।

(৬) বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ ই মার্চের ১৮ মিনিটের ভাষণ → লিখিত ছিল না।

(৭) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন → রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সােহরাওয়ার্দী উদ্যান)

(৮) “রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরাে দেবাে তবুও এ দেশের মানুষকে → মুক্ত করবাে ইনশাল্লাহ।” 

(৯) “এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই ঘােষণা দিয়েছেন → ৭ মার্চ, ১৯৭১ রেসকোর্স ময়দানে।

(১০) বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ শুরু হয় → বিকেল ৩ টা ২০ মিনিটে।

(১১) বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের স্থায়িত্বকাল ছিল—২৩ মিনিট (রেকর্ড হয় ১৮ মিনিট)। 

(১২) ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের শব্দ সংখ্যা- ১১০৮টি।

(১৩) ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের অডিও রেকর্ড করেন → এইচ এন খোন্দকার।

(১৪) ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের ভিডিও ধারণ করেন- আবুল খায়ের ।

(১৫) ৭ই মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন → বাঙালির ২৩ বছরের অত্যাচার ও শােষণের ইতিহাস।

(১৬) অসহযােগ আন্দোলনের তীব্রতা বৃদ্ধি পায় → ৭ মার্চের ভাষণের পরে।

(১৭) বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ প্রচার করা হয় → ৮ মার্চ ঢাকা বেতারে।

(১৮) বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ সর্বপ্রথম অনূদিত হয় → জাপানি ভাষায়। [★★★]

(২৯) ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু  ভাষণ দিয়েছিলেন → ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ।

(২০) ৭ই মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু চারটি বিভাগের কথা উল্লেখ করেন → ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও রংপুর।

(২১) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণকে ‘মেমােরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল’ রেজিস্টারে স্বীকৃতি দেয় → UNESCO

(২২) বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ  ইউনেস্কোর ‘মেমােরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল’ রেজিস্টারে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে → ৩০ অক্টোবর, ২০১৭ সালে।

(২৩) ‘৭ই মার্চ ভবন’  অবস্থিত → ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলে।

(২৪) ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণকে ইউনেস্কো স্বীকৃতি দিয়েছে → ‘ওয়ার্ল্ড ডকুমেন্টারি হেরিটেজ’ হিসেবে।

(২৫) ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের জন্য বঙ্গবন্ধুকে ‘রাজনীতির কবি’ উপাধি দেন → যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ম্যাগাজিন নিউজ উইক (৫ এপ্রিল ১৯৭১)

(২৬) UNESCO ৭ মার্চের ভাষণকে বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য (Memory of the World Register) ঘােষণা করে → ৩০ অক্টোবর, ২০১৭। [★★★]

(২৭) ‘দ্য স্ট্রাগল দিস টাইম ইজ দ্য স্ট্রাগল ফর ইন্ডিপেন্ডেন্টস’ শিরােনামে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের

ভাষণটি স্থান পেয়েছে যে গ্রন্থে → We shall figth on the beaches: the speeches that inspired history [বইটির সঙ্কলক – জ্যাকব এফ ফিল্ড ]

(২৮) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণকে কেন্দ্র করে নির্মিত পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচিত্র → তর্জনী।

(২৯) বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের উপর ভিত্তি করে নির্মিত চলচ্চিত্রের নাম → দ্য স্পিচ।

(৩০) বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে উল্লেখিত ‘RTC’  এর পূর্ণরূপ → Round Table conference.

(৩১) বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে → পঞ্চম তফসিলে।

(৩২) ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ ছিল মূলত বাংলাদেশের → স্বাধীনতার ঘোষণা।

(৩৩) জাতিসংঘের সব দাপ্তরিক ভাষায় বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ০৭ মার্চের ভাষণ বিষয়ক গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন করা হয় → ০৫ মার্চ, ২০২১ ।

(৩৪) জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের ওপর একটি আন্তর্জাতিক বই প্রকাশ হয়েছে। ‘দ্য হিস্টোরিক সেভেনথ মার্চ স্পিস অব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান: অ্যা ওয়ার্ল্ড ডক্যুমেন্টারি হেরিটেজ’ নামের বইটিতে জাতিসংঘের সবগুলো দাপ্তরিক ভাষায় বঙ্গবন্ধুর ভাষণ অনুদিত হয়ে অন্তর্ভূক্ত হয়েছে।  

(৩৫) ৭মার্চের ভাষণ আর গেটিসবার্গ স্পিস এর সাদৃশ্য কি ?

উত্তর: দুটোতেই শাসকগোষ্ঠীর অতীতের অত্যাচার, অবিচার,বৈষম্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে অধিকার আদায়ে সচেষ্ট হবার কথা বলা হয়েছে। মুক্তির দিকনির্দেশনা পাওয়া যায় উভয় ভাষণ থেকেই।

(৩৬) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে→ ‘রাজনীতির কবি’ উপাধি দেওয়া হয় → ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের জন্য।

(৩৭) ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ সংবিধানে আছে→ পঞ্চম তফসিলে।

★ ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের পূর্ণ বিবরণ। ★

আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সবই জানেন এবং বুঝেন। আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে।

আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়। কী অন্যায় করেছিলাম, নির্বাচনে বাংলাদেশের মানুষ সম্পূর্ণভাবে আমাকে আওয়ামী লীগকে ভোট দেন। আমাদের ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি বসবে, আমরা সেখানে শাসনতন্ত্র তৈয়ার করব এবং এই দেশকে আমরা গড়ে তুলব, এ দেশের মানুষ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি পাবে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আজ দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, তেইশ বৎসরের করুণ ইতিহাস বাংলার অত্যাচারের, বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস। তেইশ বৎসরের ইতিহাস মুমূর্ষু নর–নারীর আর্তনাদের ইতিহাস; বাংলার ইতিহাস এ দেশের মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস। ১৯৫২ সালে রক্ত দিয়েছি। ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করেও আমরা গদিতে বসতে পারি নাই। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান মার্শাল ল জারি করে দশ বৎসর পর্যন্ত আমাদের গোলাম করে রেখেছে। ১৯৬৬ সালে ছয় দফা আন্দোলনে ৭ই জুনে আমার ছেলেদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। ১৯৬৯-এর আন্দোলনে আইয়ুব খানের পতন হওয়ার পর যখন ইয়াহিয়া খান সাহেব সরকার নিলেন, তিনি বললেন, দেশে শাসনতন্ত্র দেবেন, গণতন্ত্র দেবেন। আমরা মেনে নিলাম।

তারপরে অনেক ইতিহাস হয়ে গেল, নির্বাচন হলো। আমি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সাহেবের সঙ্গে দেখা করেছি। আমি, শুধু বাংলার নয়, পাকিস্তানের মেজরিটি পার্টির নেতা হিসাবে তাঁকে অনুরোধ করলাম, ১৫ই ফেব্রুয়ারি তারিখে আপনি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন দেন। তিনি আমার কথা রাখলেন না, তিনি রাখলেন ভুট্টো সাহেবের কথা। তিনি বললেন, প্রথম সপ্তাহে মার্চ মাসে হবে। আমরা বললাম, ঠিক আছে, আমরা অ্যাসেম্বলিতে বসব। আমি বললাম, অ্যাসেম্বলির মধ্যে আলোচনা করব; এমনকি আমি এ পর্যন্ত বললাম, যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও, একজনও যদি সে হয়, তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেব।

জনাব ভুট্টো সাহেব এখানে এসেছিলেন, আলোচনা করলেন। বলে গেলেন যে আলোচনার দরজা বন্ধ না, আরও আলোচনা হবে। তারপর অন্যান্য নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলাপ করলাম, আপনারা আসুন বসুন, আমরা আলাপ করে শাসনতন্ত্র তৈয়ার করি। তিনি বললেন, পশ্চিম পাকিস্তানের মেম্বাররা যদি এখানে আসেন, তাহলে কসাইখানা হবে অ্যাসেম্বলি। তিনি বললেন, যে যাবে তাকে মেরে ফেলে দেওয়া হবে। যদি কেউ অ্যাসেম্বলিতে আসে তাহলে পেশোয়ার থেকে করাচি পর্যন্ত দোকান জোর করে বন্ধ করা হবে। আমি বললাম, অ্যাসেম্বলি চলবে। তারপর হঠাৎ ১ তারিখে অ্যাসেম্বলি বন্ধ করে দেওয়া হলো।

ইয়াহিয়া খান সাহেব প্রেসিডেন্ট হিসাবে অ্যাসেম্বলি ডেকেছিলেন। আমি বললাম যে, আমি যাব। ভুট্টো সাহেব বললেন, তিনি যাবেন না। ৩৫ জন সদস্য পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এখানে আসলেন। তারপরে হঠাৎ বন্ধ করে দেওয়া হলো। দোষ দেওয়া হলো বাংলার মানুষকে, দোষ দেওয়া হলো আমাকে। বন্দুকের মুখে মানুষ প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠল।

আমি বললাম, শান্তিপূর্ণভাবে আপনারা হরতাল পালন করেন। আমি বললাম, আপনারা কলকারখানা সবকিছু বন্ধ করে দেন। জনগণ সাড়া দিল। আপন ইচ্ছায় জনগণ রাস্তায় বেরিয়ে পড়ল। তারা শান্তিপূর্ণভাবে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো।

মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ্।

কী পেলাম আমরা? যে আমার পয়সা দিয়ে অস্ত্র কিনেছি বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য, আজ সেই অস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে আমার দেশের গরিব-দুঃখী আর্ত মানুষের বিরুদ্ধে, তার বুকের উপর হচ্ছে গুলি। আমরা পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু। আমরা বাঙালিরা যখনই ক্ষমতায় যাবার চেষ্টা করেছি, তখনই তারা আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। টেলিফোনে আমার সঙ্গে তাঁর কথা হয়। তাঁকে আমি বলেছিলাম, জনাব ইয়াহিয়া খান সাহেব, আপনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট, দেখে যান কীভাবে আমার গরিবের উপরে, আমার বাংলার মানুষের উপরে গুলি করা হয়েছে, কী করে আমার মায়ের কোল খালি করা হয়েছে। আপনি আসুন, দেখুন, বিচার করুন। তিনি বললেন, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, ১০ তারিখে রাউন্ড টেবিল কনফারেন্স ডাকব।

আমি বলেছি, কিসের বৈঠক বসবে, কার সঙ্গে বসব? যারা আমার মানুষের বুকের রক্ত নিয়েছে, তাদের সঙ্গে বসব? হঠাৎ আমার সঙ্গে পরামর্শ না করে পাঁচ ঘণ্টা গোপনে বৈঠক করে যে বক্তৃতা তিনি করেছেন, সমস্ত দোষ তিনি আমার উপরে দিয়েছেন, বাংলার মানুষের উপর দিয়েছেন।

ভাইয়েরা আমার, ২৫ তারিখে অ্যাসেম্বলি কল করেছে। রক্তের দাগ শুকায় নাই। আমি ১০ তারিখে বলে দিয়েছি যে ওই শহীদের রক্তের উপর পা দিয়ে কিছুতেই মুজিবুর রহমান যোগদান করতে পারে না। অ্যাসেম্বলি কল করেছে। আমার দাবি মানতে হবে: প্রথম, সামরিক আইন মার্শাল ল উইথ ড্র করতে হবে, সমস্ত সামরিক বাহিনীর লোকদের ব্যারাকে ফেরত নিতে হবে, যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তার তদন্ত করতে হবে, আর জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে । তারপর বিবেচনা করে দেখব, আমরা অ্যাসেম্বলিতে বসতে পারব কি পারব না। এর পূর্বে অ্যাসেম্বলিতে বসতে আমরা পারি না।

আমি, আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না। আমরা এ দেশের মানুষের অধিকার চাই। আমি পরিষ্কার অক্ষরে বলে দিবার চাই যে আজ থেকে এই বাংলাদেশে কোর্ট-কাচারি, আদালত-ফৌজদারি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। গরিবের যাতে কষ্ট না হয়, যাতে আমার মানুষ কষ্ট না করে, সে জন্য সমস্ত অন্যান্য জিনিসগুলো আছে, সেগুলির হরতাল কাল থেকে চলবে না। রিকশা, গরুর গাড়ি চলবে, রেল চলবে, লঞ্চ চলবে; শুধু সেক্রেটারিয়েট, সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্ট, জজকোর্ট, সেমি গভর্নমেণ্ট দপ্তরগুলো, ওয়াপদা কোনো কিছু চলবে না।

২৮ তারিখে কর্মচারীরা বেতন নিয়ে আসবেন। এর পরে যদি বেতন দেওয়া না হয়, আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোকদের হত্যা করা হয়, তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে, এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু, আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে। আমরা ভাতে মারব, আমরা পানিতে মারব। তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাকো, কেউ তোমাদের কিছু বলবে না। কিন্তু আর আমার বুকের উপর গুলি চালাবার চেষ্টা করো না। সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দমাতে পারবে না।

আর যে সমস্ত লোক শহীদ হয়েছে, আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে, আমরা আওয়ামী লীগের থেকে যদ্দুর পারি তাদের সাহায্য করতে চেষ্টা করব। যারা পারেন আমার রিলিফ কমিটিতে সামান্য টাকাপয়সা পৌঁছিয়ে দেবেন। আর এই সাত দিন হরতালে যে সমস্ত শ্রমিক ভাইরা যোগদান করেছেন, প্রত্যেকটা শিল্পের মালিক তাঁদের বেতন পৌঁছায়ে দেবেন। সরকারি কর্মচারীদের বলি, আমি যা বলি তা মানতে হবে। যে পর্যন্ত আমার এই দেশের মুক্তি না হবে খাজনা-ট্যাক্স বন্ধ করে দেওয়া হলো, কেউ দেবে না। মনে রাখবেন, শত্রুবাহিনী ঢুকেছে, নিজেদের মধ্যে আত্মকলহ সৃষ্টি করবে, লুটপাট করবে। এই বাংলায় হিন্দু মুসলমান বাঙালি অবাঙালি যারা আছে, তারা আমাদের ভাই। তাদের রক্ষার দায়িত্ব আপনাদের উপরে। আমাদের যেন বদনাম না হয়। মনে রাখবেন রেডিও টেলিভিশনের কর্মচারীরা, যদি রেডিওতে আমাদের কথা না শোনেন, তাহলে কোনো বাঙালি রেডিও স্টেশনে যাবেন না। যদি টেলিভিশন আমাদের নিউজ না দেয়, কোনো বাঙালি টেলিভিশনে যাবেন না। দুই ঘণ্টা ব্যাংক খোলা থাকবে, যাতে মানুষ তাদের মায়নাপত্র নিবার পারে। কিন্তু পূর্ব বাংলা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে এক পয়সাও চালান হতে পারবে না। টেলিফোন টেলিগ্রাম আমাদের এই পূর্ব বাংলায় চলবে এবং বিদেশের সঙ্গে নিউজ পাঠাতে চালাবেন। কিন্তু যদি এ দেশের মানুষকে খতম করার চেষ্টা করা হয়, বাঙালিরা বুঝে–শুনে কাজ করবেন। প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোল এবং তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ্। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।

জয় বাংলা।

সূত্র: বাংলাপিডিয়া, খণ্ড ১৩, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি

★★ গেটিসবার্গ থেকে রেসকোর্স:

পেনসিলভানিয়ারই একটি জায়গার নাম গেটিসবার্গ, আরেকটি জায়গা ফিলাডেলফিয়া। ইতিহাসের বিচারে আমেরিকার স্বাধীনতা লাভের মূলে ফিলাডেলফিয়ার একটি অবিস্মরণীয় ভূমিকা রয়েছে, কিন্তু গেটিসবার্গের পরিচিতির মূলে কারণ অন্য। এখানেই আব্রাহাম লিংকন মানবসভ্যতার ইতিহাসে অন্যতম শ্রেষ্ঠ বক্তৃতাটি দিয়েছিলেন। ১৮৬৩ সাল আমেরিকার ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ বছর লিংকন তাঁর বিখ্যাত গেটিসবার্গ বক্তৃতাটি করেন। তখন আমেরিকায় গৃহযুদ্ধ চলছে। ১৮৬৩ সালের ১৯ নভেম্বর প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন সফর করেন গেটিসবার্গ। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, লিংকনের বক্তৃতার শব্দসংখ্যা ছিল মাত্র ২৭২। মাত্র দুই মিনিটের এই বক্তৃতাটি ইংরেজি ভাষায় এবং আমেরিকার ইতিহাসে অন্যতম শ্রেষ্ঠ বক্তৃতা। চমকপ্রদ সত্য হচ্ছে, বঙ্গবন্ধুর ১৮ মিনিটের ভাষণ লিখিত ছিল না। তাঁর সামনে মাইক্রোফোন ও লাখ লাখ মানুষ ছাড়া আর কিছু ছিল না। কিন্তু কী নির্ভুল, নিঃশঙ্ক উচ্চারণ। সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা বেরোচ্ছে তাঁর মুখ দিয়ে। আমরা জেনেছি, ৬ মার্চ রাতে তিনি সমমনা রাজনৈতিক নেতাদের কথা শুনেছেন, ছাত্রনেতাদের বক্তব্য জেনেছেন, অর্থাৎ সব জেনে-শুনে তিনি নিজের মতো করে বক্তৃতাটি তৈরি করেছেন। শুধু পরিস্থিতি বিবেচনা করে বলা যায়, ৭ মার্চ ১৯৭১ বাংলাদেশের বাঙালির জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণের তারিখ। পরে জানা গেছে, বঙ্গবন্ধু যদি সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা করতেন, তাহলে ওই রেসকোর্সে হাজার হাজার মানুষের লাশ পড়ত, পঙ্গু হতো লাখ লাখ মানুষ। গেটিসবার্গে লিংকন ও রেসকোর্সে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের চরিত্রগত মিল-অমিল হচ্ছে বাঁচা না-বাঁচার প্রশ্নটি। লিংকন বক্তৃতা করেছেন আমেরিকার গৃহযুদ্ধের পটভূমিতে; বঙ্গবন্ধু করেছেন স্বাধীনতা লাভের অঙ্গীকারে। লিংকনের বক্তৃতার একটা লিখিত রূপ ছিল। ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব ইন্টেরিয়র থেকে প্রকাশিত বিবরণমালায় লিংকনের বক্তৃতা সম্পর্কে বলা হয়েছে, সাধারণভাবে একটি বিশ্বাস ব্যাপকভাবে প্রচলিত আছে, গেটিসবার্গ যাওয়ার পথে লিংকন বক্তৃতাটি খামের পেছনে লিখে নিয়েছিলেন। কিন্তু আসলে লিংকন এই বক্তৃতাটি তৈরির পেছনে যথেষ্ট সময় দিয়েছিলেন। তিনি ওয়াশিংটনে বসেই বক্তৃতাটির একটি খসড়া তৈরি করেছিলেন। পরে ডেভিড উইলের বাড়িতে বসে সেটি তিনি সংশোধন ও সম্পাদনা করেন। ইতিহাস নিশ্চিতভাবেই একদিন প্রমাণ করবে, পৃথিবীর দুই প্রান্তের দুই নেতা মানুষের মুক্তির জন্য জীবনপণ করে সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। তাঁরা মানুষের ভালোবাসা পেয়েছিলেন, কিন্তু কিছু ষড়যন্ত্রী তাঁদের স্বাভাবিক মৃত্যুর স্বাদ নিতে দেয়নি। আততায়ীর গুলিতে নিহত হন লিংকন; আততায়ীর গুলি মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয় বঙ্গবন্ধুকে—দুই মেয়ে বাদে বঙ্গবন্ধুর পুরো পরিবারকে।

সূত্র: জাকির বিসিএস এর ফেসবুক পোস্টের কমেন্ট থেকে নেওয়া।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Shopping Cart
error: Content is protected !!