★★ উপপদ তৎপুরুষ সমাসের বৈশিষ্ট্য:
উপপদ তৎপুরুষ সমাসের পূর্বপদটি বিশেষ্য ও পরপদটি কৃদন্ত পদ হয়। কৃদন্ত পদকে ক্রিয়াবাচক পদও বলা হয়।
★★ কৃদন্ত পদ কাকে বলে?
কৃদন্ত শব্দের অর্থ হল কৃৎ অন্তে যার; অর্থাৎ, যার শেষে কৃৎ প্রত্যয় আছে। কৃৎ+অন্ত= কৃদন্ত।
আমরা জানি, যে প্রত্যয়গুলি ধাতুর পরে যুক্ত হয়ে শব্দ গঠন করে তাদের কৃৎ প্রত্যয় বলে। এইভাবে ধাতুর সাথে কৃৎ প্রত্যয় যুক্ত হয়ে গঠিত নামপদকে কৃদন্ত পদ বলে।
কৃদন্ত পদ দুই প্রকার হয়। কতকগুলি কৃদন্ত পদ ভাষায় স্বাধীন শব্দ রূপে ব্যবহৃত হয় আর কতকগুলি কৃদন্ত পদ স্বাধীন ভাবে ব্যবহৃত হতে পারে না, কারও না কারও আশ্রয়ের প্রয়োজন হয়। কে দেবে আশ্রয়? কৃদন্ত পদকে আশ্রয় দিতে পারে
১: উপসর্গ, ২: নামপদ (উপপদ)। যেমন-
(আ+হার) = আহার। এখানে ‘আ’ হল উপসর্গ, ‘হার’ হল কৃদন্ত পদ। একই ভাবে উপকার (উপ+কার), সংস্কার (সম্+কার), অনুকার, অনুজ, বিহার, প্রহার প্রভৃতি শব্দগুলি উপসর্গ ও আশ্রিত কৃদন্ত পদের যোগে গঠিত হয়েছে। এখানে আশ্রিত কৃদন্ত পদকে আশ্রয় দিচ্ছে উপসর্গ। কিন্তু এই আশ্রয় দেওয়ার কাজটিই যদি কোনো নামপদ করে থাকে, তখনই হবে উপপদ তৎপুরুষ সমাস। যেমন: ‘কুম্ভকার’ (কুম্ভ+কার) শব্দে ‘কার’ কৃদন্ত পদটিকে আশ্রয় দেওয়ার কাজটি করছে ‘কুম্ভ’ (মানে কলসী) বিশেষ্য পদটি। তাই কুম্ভ পদটিকে আমরা বলবো উপপদ। এইভাবে উপসর্গের সাথে কাজের সাদৃশ্যের জন্য এদের উপপদ বলা হয়।
★★ উপপদ কাকে বলে?
কৃদন্ত পদের পূর্বে অবস্থিত (আশ্রয়দাতা) নামপদকে উপপদ বলে। উপপদ কথার আক্ষরিক অর্থ ‘পূর্বে অবস্থিত পদ’।
★★ উপপদ তৎপুরুষ সমাস চেনার উপায়:
উপপদ তৎপুরুষ সমাস চেনার জন্য নিচের পদ্ধতি অনুসণ করুন
(১) প্রথমেই দেখতে হবে, পরপদে কৃদন্ত পদ বা ক্রিয়াবাচক পদ আছে কিনা। যদি থাকে, তাহলে উপপদ তৎপুরুষ সমাস হতে পারে।
(২) কৃদন্ত পদটিকে ভাষায় স্বাধীন ভাবে ব্যবহার করা যায় কিনা দেখতে হবে। যদি না যায়, তাহলে এটি উপপদ তৎপুরুষ সমাস হতে পারে।
(৩) পূর্বপদটি নামপদ কিনা। নামপদ বলতে এখানে মূলত বিশেষ্য ও বিশেষণ পদই হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিশেষ্যই হয়। বিশেষণ কমই দেখা যায়।
এই তিনটি শর্ত মিলে গেলে একটি সমাসবদ্ধ পদকে উপপদ তৎপুরুষ সমাস বলা যাবে।
★★ উপপদ তৎপুরুষ সমাসের পপরপদে যে কৃদন্ত পদগুলি ব্যবহৃত হয় তেমন কিছু কৃদন্ত পদের অর্থসহ উদাহরণ ও উপযুক্ত একটি করে সমাসবদ্ধ পদের উদাহরণ দেওয়া হলো।
কৃদন্ত পদ – অর্থ উদাহরণ
কর, কার, কারী – করা অর্থে কর্মকার
গ, গামী – গমন করা অর্থে ভুজগ
জ, জা – জন্মগ্রহণ করা অর্থে জলজ
বদ, বদা, বাদী – বলা অর্থে সত্যবাদী
ঘ্ন – হত্যা করা অর্থে শত্রুঘ্ন
জিৎ – জয় করা অর্থে ইন্দ্রজিৎ
প – পান করা অর্থে পাদপ
দ,দা, দায়ী- দেওয়া অর্থে বরদা
সহ – সহ্য করা অর্থে ভারসহ
পাতী- পতন অর্থে – অন্তঃপাতী ধারী – ধারণ করা অর্থে অস্ত্রধারী
স্থ, স্থা – থাকা অর্থে মুখস্থ
গ্রাহী – গ্রহণ করা অর্থে তাপগ্রাহী
বাসী – বাস করা আর্থে গৃহবাসী
দর্শী – দর্শন করা অর্থে প্রিয়দর্শী
বাহী – বহন করা অর্থে ভারবাহী
চর – বিচরণ করা বা চরা অর্থে খেচর
★★ মনে রাখতে হবে: বাক্য সংক্ষেপণ (এক কথায় প্রকাশ) ঘটে থাকলে এবং সমস্তপদের শেষে ক্রিয়া (কাজ)-বাচক পদ যুক্ত থাকলেই সেগুলো সাধারণত উপপদ তৎপুরুষ সমাস হয়।
★★ উদাহরণ ও ব্যাখ্যা:
বাক্য সংক্ষেপণ (এক কথায় প্রকাশ):
জলচর (জলে চরে যা), পঙ্কজ (পঙ্কে জন্মে যা), সত্যবাদী (সত্য বলে যে), ইন্দ্রজিৎ (ইন্দ্রকে জয় করেছে যে)।
★ এ সমাসের ব্যাসবাক্য করাও খুবই সহজ। অর্থ অনুসারে যে/যা/যাতে বসিয়ে দিলেই ব্যাসবাক্য হয়ে যায়। যেমন: ছা-পোষা = ছা পোষে যে, হাড়ভাঙা = হাড় ভাঙে যাতে।
★ সমস্তপদের শেষে ক্রিয়াবাচক পদ:
পকেটমার। এখানে ‘মার’ একটি ক্রিয়াবাচক পদ।
ছেলেধরা। এখানে ‘ধরা’ একটি ক্রিয়াবাচক পদ।
পাতাচাটা। এখানে ‘চাটা’ একটি ক্রিয়াবাচক পদ।
মাছিমারা। এখানে ‘মারা’ একটি ক্রিয়াবাচক পদ।
★★ উপপদ তৎপুরুষ সমাসের ৭১ টি উদাহরণ:
জলে চরে যা = জলজ
জলে জন্মে যা = জলজ
পঙ্কে জন্মে যা = পঙ্কজ
আত্মা থেকে জন্ম যার = আত্মজ
অনুতে জন্মে যে = অনুজ
জল দেয় যে = জলদ
অম্বু দান করে যে = অম্বুদ
সহ জাত যা = সহজ
ছেলে ধরে যে = ছেলেধরা
ধামা ধরে যে = ধামাধরা
মাকে হারিয়েছেন যিনি = মাতৃহারা
মাছি মারে যে = মাছিমারা
বর্ণ চুরি করে যে = বর্ণচোরা
মনকে চুরি করে যে = মনচোরা
পুথি পড়ে যে = পুথিপোড়া
সব হারিয়েছে যে = সর্বহারা
নিদকে হারিয়েছেন যিনি = নিদহারা
দিশাকে হারিয়েছেন যিনি = দিশাহারা
মনে মরেছে যে = মনমরা
পকেট মারে যে = পকেটমার
কুম্ভ করে যে = কুম্ভকার
অন্ধ করে যে = অন্ধকার
স্বর্ণ করে যে = স্বর্ণকার
পা চাটে যে = পা-চাটা
গলা কাটে যে = গলাকাটা
সর্বনাশ করে যে = সর্বনাশা
টনক নড়ে যাতে = টনকনড়া
হাড় ভাঙ্গে যাতে = হাড়ভাঙ্গা
বুক ভাঙ্গে যে = বুকভাঙ্গা
চা পোষে যে = ছা-পোষা
অগ্রে গমন করে যে = অগ্রগামী
সত্য কথা বলে যে = সত্যবাদী
মিথ্যা কথা বলে যে মিথ্যাবাদী
সব্য সচন করেন যিনি = সব্যসাচী
ক্ষীণভাবে বাঁচে যে = ক্ষীণজীবী
অর্থ করা যায় যার দ্বারা = অর্থকরী
বিদ্যা ধারণ করেন যিনি = বিদ্যাধরী
জটাজুট ধারণ করেন যিনি = জটাজুটধারী
মন হরণ করে যে (নারী) = মনোহারিণী
অভ্রকে ভেদ করেন যিনি = অভ্রভেদী
মৃৎ ভেদ করে যে = মৃদভেদী
একান্নে (এক অন্নে) বর্তে যে = একান্নবর্তী
প্রিয় কথা বলে যে নারী = প্রিয়ংবদা
গৃহে থাকে যে = গৃহস্থ
খ (আকাশে) তে চরে যে = খেচর
ভূ তে চরে যে = ভূচর
জলে চরে যে = জলচর
নিশাতে চরে যে = নিশাচর
বনে চরে যে = বনেচর
মনকে হরণ করেন যিনি = মনোহর
প্রভা করে যে = প্রভাকর
দিবা করে যে = দিবাকর
বাজি করে যে = বাজিকর
জাদু করে যে = জাদুকর
অনিষ্ট করে যে = অনিষ্টকর
সূত্রকে ধারণ করেন যিনি = সূত্রধর
হালুই করে যে = হালুইকর
ইন্দ্রকে জয় করেছে যে = ইন্দ্রজিৎ
সত্যকে জয় করেছেন যিনি = সত্যজিৎ
মৃত্যুকে জয় করেন যিনি = মৃত্যুঞ্জয়
গো পালন করে যে = গোপ
গিরিতে শয়ন করেন যিনি = গিরীশ
ভূজে অঙ্গ থাকে যার = ভূজঙ্গ
ধর্ম জানেন যিনি = ধর্মজ্ঞ
অরিকে দমন করেন যিনি = অরিন্দম
সবকিছু জানেন যিনি = সবজান্তা
বিহায়সে গমন করেন যে = বিহগ
বর দান করেন যিনি = বরদ
দ্বি পান করে যে = দ্বিপ
কাঠ কুড়ায় যে = কাঠকুড়ুনী
অর্থকে বহন করেন যিনি = অর্থবহ
★★ এখানে আগে এমন কিছু উদাহরণ দেবো যেগুলিকে উপপদ তৎপুরুষ বলে মনে হলেও উপপদ তৎপুরুষ সমাস হবে না।
পরপদে চালক, দাতা, গ্রহীতা, প্রাপক, পাঠক, দৃশ্য, মৃত, চালিত, ইত্যাদি স্বাধীন কৃদন্ত পদ থাকলে সেগুলি উপপদ তৎপুরুষ সমাস হবে না। যেমন: ঋণগ্রহীতা = ঋণের গ্রহীতা, সম্বন্ধ তৎপুরুষ সমাস। কারণ ‘গ্রহীতা’ পদটি এখানে ‘ঋণ’ পদটির আশ্রয়ে ব্যবহৃত হয়নি। এটি একটি স্বাধীন পদ।
কিন্তু বলকারক = বল করে যা, উপপদ তৎপুরুষ সমাস হবে। এখানে ‘কারক’ পদটি কৃদন্ত পদ এবং এর স্বাধীন ব্যবহার আছে। তবু উপপদ তৎপুরুষ সমাস হচ্ছে, কারণ ‘কারক’ পদটি ভাষায় স্বাধীন ভাবে ব্যবহৃত হলেও তা বিশিষ্ট অর্থে ব্যবহৃত হয়, ‘যে করে’-এই অর্থে নয়। অপরদিকে ‘ঋণগ্রহীতা’ সমস্তপদে ‘গ্রহীতা’ পদটি ‘যে গ্রহণ করে’ – এই অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ, কৃদন্ত পদটির স্বাধীন অর্থ থাকলেও তা যদি সাধারণ অর্থ না হয়ে বিশেষ অর্থ হয়, তাহলেও উপপদ তৎপুরুষ সমাস হবে। সমাসবদ্ধ পদে একটি স্বাধীন কৃদন্ত পদ নিজের স্বাভাবিক অর্থে ব্যবহৃত হলে উপপদ তৎপুরুষ সমাস হয় না।