সেক্যুলারিজম-এর মূলকথা ও এর বিকৃত সংজ্ঞা
লেখক: ড. আহমদ আলী
বিদআত ৮ম খণ্ড, (আধুনিক চিন্তাধারা ও মতবাদ’) [প্রকাশিতব্য] বই থেকে।
উপর্যুক্ত সংজ্ঞাগুলো থেকে সেক্যুলারিজমের যেসব নীতি ও বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে-
ক. ধর্ম থাকবে মানুষের একান্ত ব্যক্তিগত জীবনে। এটি তার নিজস্ব ব্যাপার। ধর্মীয় কর্মকাণ্ডকে একান্ত ব্যক্তিগত পর্যায়ে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে।
খ. মানব জীবনের অন্য সকল দিক ও বিভাগকে ধর্মের প্রভাব থেকে মুক্ত রাখা। এতে পার্থিব জীবনের সকল ক্ষেত্রে ধর্মের সম্পৃক্ততা অস্বীকার কিংবা উপেক্ষা করা হয়।
গ. রাজনীতি ও ধর্ম সম্পূর্ণ আলাদা। রাজনীতির সাথে ধর্ম সংযুক্ত থাকবে না। রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণ ও পরিচালনায় কোনোভাবেই ধর্মকে বিবেচনা করা যাবে না।
ঘ. রাষ্ট্রের সমাজ, শিক্ষা-সংস্কৃতি, অর্থনীতি, বিচার ও শাসন, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক- সবকিছু ধর্মভিত্তিক বিধিবিধানের পরিবর্তে মানুষের বুদ্ধিজাত আইন ও সিদ্ধান্ত দ্বারা পরিচালিত হবে। এ মতবাদ অনুযায়ী মানুষ তার নিজস্ব বুদ্ধি-বিবেচনার মাধ্যমে তার বাঞ্ছিত উদ্দেশ্য পূর্ণাঙ্গভাবে অর্জন করতে পারে। এ ক্ষেত্রে ধর্মের কোনো স্থান নেই।
ঙ. মুসলিম জগতে সেক্যুলারিজম মানেই ইসলামমুক্ত শাসন; ইসলামকে ব্যক্তির একান্ত জীবনে সীমাবদ্ধ রেখে সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনা করা; ইসলাম থেকে রাষ্ট্র ও রাজনীতিকে সম্পূর্ণ পৃথক করা।
>>>>
সেক্যুলারিজম-এর বিকৃত সংজ্ঞা
*** ***
উপর্যুক্ত সংজ্ঞাগুলো থেকে জানা যায় যে,
সেক্যুলারিজম সর্বতোভাবে ধর্মমুক্ত একটি বৈষয়িক দর্শন, যার অনিবার্য পরিণতি হলো- ধর্মহীনতা, (জীবনের সকল কিংবা অধিকাংশ ক্ষেত্রে) ধর্মের সাথে সম্পর্কহীনতা।
এ কারণে আরবী ও উর্দুতে তার এ ফলাফলের দিকে লক্ষ্য রেখে এর অনুবাদ করা হয়- ‘লা-দীনিয়্যাহ’ অর্থাৎ ধর্মহীনতা। The Oxford Dictionary -তেও Secular -এর অর্থ করা হয়েছে, not connected with spiritual or religious matters অর্থাৎ যা আধ্যাত্মিক বা ধর্মীয় বিষয়াবলির সাথে সম্পর্কহীন।
কিন্তু সাম্প্রতিককালে আমাদের কতিপয় মুসলিম বুদ্ধিজীবী সেক্যুলারিজমকে ‘ধর্মহীনতা’ বলতে নারাজ। তারা বোঝাতে চান যে, সেক্যুলারিজম হলো-
‘বিশেষ কোনো ধর্মের ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের মূল ভিত্তি প্রতিষ্ঠা বা প্রশাসন পরিচালনা না করে সকল ধর্মের মানুষের জন্য ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করা।’
তাদের মতে,
সেক্যুলারিজম কারো ধর্মপালনে কোনো বাধা তৈরি করে না। রাষ্ট্রে কেউ যদি প্রয়োজন মনে করে, তাহলে সে তার একান্ত ব্যক্তিগত পরিমণ্ডলে ধর্মাচারের অনুশীলন করতেই পারে।
এ ক্ষেত্রে তাদের কেউ কেউ রশীদ ঘানুশীকে দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখাতে চেষ্টা করেন। তারা বলেন, রশীদ ঘানুশী তিউনিসিয়ায় স্বৈরশাসনের পতনের পর সেক্যুলারিজম সম্পর্কে নতুন বিবেচনা উপস্থাপন করেন। তিনি বলেছেন, ‘আমরা প্রমাণ করেছি, সেক্যুলারিজম কোনো নাস্তিক্যবাদী মতবাদ নয়; বরং এটা কেবল বিশ্বাস ও চিন্তার স্বাধীনতা হেফাজত করার উদ্দেশ্যে একটা নিয়মতান্ত্রিক ব্যবস্থামাত্র।’
সেক্যুলারিজম-এর এরূপ ব্যাখ্যা প্রথমত উপরিউক্ত স্বীকৃত সংজ্ঞাগুলোর মূলভাব ধারণ করে না।
দ্বিতীয়ত, যদিও ধরে নিই যে, সেক্যুলারিজম প্রসঙ্গে আমাদের মুসলিম সেক্যুলার বুদ্ধিজীবীদের উপর্যুক্ত ব্যাখ্যাই যথার্থ, তাহলেও প্রশ্ন থাকে যে, এরূপ ব্যাখ্যা ইসলাম সমর্থন করে কিনা?
কারণ, এ ব্যাখ্যায়ও সেক্যুলারিজমের দুটি দিক রয়েছে,
ক. রাষ্ট্রের সাংবিধানিক কাঠামো থেকে শরীয়াকে ছুঁড়ে ফেলা।
খ. সকল ধর্ম ও কালচারের ব্যাপারে নিরপেক্ষ হয়ে ধর্মীয়ভাবে সকলকে সমান অধিকার প্রদান করা।
তৃতীয়ত, এরূপ ব্যাখ্যা বাস্তবতার সাথেও সঙ্গতিপূর্ণ নয়। মূলত এরূপ ব্যাখ্যার মাধ্যমে সাধারণ মুসলিম-মানসকে প্রতারিত করা হয়। যারা এরূপ কথা বলেন তারা হয় ধর্মবিদ্বেষী অথবা ইসলাম সম্পর্কে আস্ত জাহিল।
কেননা,
ক. সেক্যুলারিজম-এর এরূপ ব্যাখ্যা যদিও যুক্তিগ্রাহ্য, অধিকন্তু এ ব্যাপারে ইসলামের সুস্পষ্ট নির্দেশনাও রয়েছে;
কিন্তু তার মূল লক্ষ্য এটা নয়; বরং এর আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে, যেমন ইতঃপূর্বে উল্লেখিত সংজ্ঞাগুলো থেকে বোঝা যায়,
মানুষের জীবনের প্রায় সকল বিভাগ থেকে ধর্মকে চিরতরে মুছে ফেলা; মানুষকে সার্বিকভাবে ধর্মের প্রতি বীতশ্রদ্ধ ও অনীহ করে তোলা; এমনকি একান্ত ব্যক্তিগত জীবনকেও ধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা।
কারণ, সমাজ ও রাষ্ট্র পর্যায়ে যদি ধর্মের অনুশীলন না থাকে; সমাজ ও রাষ্ট্র দেশের নাগরিকদের মধ্যে ধর্মচর্চার মনোবৃত্তি তৈরি ও বৃদ্ধির কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ না করে এবং বাধাহীনভাবে ধর্ম পালনের সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন পরিবেশ গড়ে না তোলে, তবে ব্যক্তিগতপর্যায়েও ধর্মপালন যে ক্রমশ সংকুচিত হয়ে আসবে এবং একপর্যায়ে এসে মানুষ একেবারেই ধর্মীয় চেতনাশূন্য হয়ে যাবে- তা বলাই বাহুল্য।
তদুপরি সেক্যুলারিজমে উপর্যুক্ত ব্যাখ্যাটা যখনই মেনে নেয়া হচ্ছে, তখন সাথে এটাও মেনে নেয়া হচ্ছে যে, রাষ্ট্রের ভিত্তি ইসলামী শরীয়া হবে না। আর তখন নিশ্চিতভাবেই প্রশ্ন জাগে, তাহলে কোন্ মাপকাঠির ভিত্তিতে সেক্যুলার রাষ্ট্রীয় আইনগুলো গড়ে ওঠবে?
নিশ্চিতভাবে সেই মাপকাঠি হবে পশ্চিমা হিউম্যানিজম (মানবতাবাদ)। অন্য কোনো মাপকাঠি নিলেও মনে রাখতে হবে যে, প্রতিটি মাপকাঠি কোনো না কোনো ফ্যাক্ট দ্বারা প্রভাবিত এবং পক্ষপাতদুষ্ট। নিরপেক্ষ বলতে আদতে পৃথিবীতে কোনো কিছুরই অস্তিত্ব নেই। কাজেই সেক্যুলার রাষ্ট্রের কোনোই ধর্ম নেই- সেক্যুলার বুদ্ধিজীবীদের এ কথা সর্বার্থে সঠিক নয়। এরও ধর্ম আছে সেটা হলো- পশ্চিমা হিউম্যানিজম বা মানবধর্ম। এর কালিমা হলো- ‘লা ইলাহা ইল্লাল ইনসান’ অর্থাৎ সবার উর্ধ্বে স্থিতি হলো মানুষের, মানুষকে ভালোবাসাই হলো শ্রেষ্ঠ উপাসনা।
খ. সেক্যুলারিজম-এর এরূপ ব্যাখ্যা কিছু ধর্মের সাথে গেলেও ইসলামের সাথে মোটেও যায় না। এ ব্যাখ্যা ইসলামী শরীয়তের মূল দর্শন ও জ্ঞানতত্ত্বের ট্রাডিশনাল অবস্থানের সাথে চরমভাবে সাংঘর্ষিক। কারণ, ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা। এতে যেমন মানুষের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে নির্দেশনা রয়েছে, তেমনি তার জীবনের সকল দিক ও বিভাগের জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা রয়েছে। ইসলাম অনুসারে দীন ও দুনিয়া- অবিচ্ছেদ্য। এখানে দীন থেকে দুনিয়াকে, রাজনীতিকে দীন থেকে আলাদা করার কোনো সুযোগ নেই। তদুপরি ইসলাম কোনো মুমিনের জন্য এ সুযোগ রাখেনি যে, সে তার একান্ত ব্যক্তিজীবনে ধর্মের অনুশাসন মেনে চলবে; বাকী অন্যান্য ক্ষেত্রে সে স্বাধীন, সে তার নিজের ইচ্ছামতো কিংবা অন্যদের মর্জিমতো চলতে পারবে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَمَا كَانَ لِمُؤْمِنٍ وَلَا مُؤْمِنَةٍ إِذَا قَضَى اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَمْرًا أَنْ يَكُونَ لَهُمُ الْخِيَرَةُ مِنْ أَمْرِهِمْ وَمَنْ يَعْصِ اللَّهَ وَرَسُولَهُ فَقَدْ ضَلَّ ضَلَالًا مُبِينًا﴾
যে বিষয়ে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কোনো ফায়সালা দেবে, তাতে কোনো মুমিন নর-নারীর জন্য এ ইখতিয়ার নেই যে, সে তা লঙ্ঘন করবে। আর যে এরূপ করবে সে সুস্পষ্ট গোমরাহীতে লিপ্ত হবে।”
সেক্যুলার বুদ্ধিজীবীরা ধর্মকে মনে করেন এক শ্বেতশুভ্র বস্ত্রখণ্ডের ন্যায়, যা রাজনীতির ময়দানে টেনে নিয়ে আসলে কালিমালিপ্ত হবে। এদের বিবেচনায় ধর্ম রাজনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতিকে বিশুদ্ধ করার পরিবর্তে নিজেই সমাজ ও রাজনীতির পঙ্কিলতায় সমর্পিত হয়। বস্তুতপক্ষে ধর্মকে নিষ্ক্রিয় বস্ত্রখণ্ডের পরিবর্তে সক্রিয় ডিটারজেন্টের সাথে তুলনা করা যায়, যা তার অন্তর্গত ক্ষমতা দিয়ে রাজনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতিকেও শুভ্র ও পবিত্র করবে। ধর্ম যদি অবশ্য পালনীয় আদেশ-নিষেধ ও উপদেশ সাবধানতার সমষ্টি হয়ে থাকে, তাহলে তার তুলনা শুচীশুভ্র বস্ত্রখণ্ডের পরিবর্তে পরিচ্ছন্নতার ক্ষমতাসম্পন্ন ডিটারজেন্ট বা সাবানের সাথে হওয়াই বাঞ্ছনীয়। সুতরাং রাজনীতিতে ধর্ম টেনে না আনার দাবি নেহায়েত অজ্ঞতাপ্রসূত এবং একবোরেই অগ্রহণযোগ্য।
রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে ধর্মের প্রবেশ নিষিদ্ধকরণের অযৌক্তিক প্রস্তাবনা সমাজ ও সভ্যতার জন্য খুবই ক্ষতিকর। উদাহরণস্বরূপ, একজন ব্যক্তি তার ধর্মাচরণের কারণে ব্যক্তিগত জীবনে সৎ ও ন্যায়বান। এই ব্যক্তি তার রাজনৈতিক জীবনে ধর্মাচার না করার অর্থ হচ্ছে, তিনি মিথ্যাচার করতে পারবেন, অন্যের কুৎসা রটাতে পারবেন, গুজব ছড়াতে পারবেন, এক কথায় যাবতীয় অন্যায় করার জন্য তিনি লাইসেন্সপ্রাপ্ত। পক্ষান্তরে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ধর্মের বিধিনিষেধ মেনে চললে তিনি এসব অপকর্ম করতে পারতেন না।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, রাজনীতিতে ধর্মকে প্রবেশাধিকার দিতে যারা কুন্ঠিত তারা প্রকৃতপক্ষে এক বল্গাহীন রাজনৈতিক অঙ্গনের প্রত্যাশা করে থাকেন, যা তাদের অসুস্থ মানসিকতার পরিচায়ক।
মোটকথা, সেক্যুলারিজম-কে যেভাবে সংজ্ঞায়িত করা হোক- এর নিশ্চিত ফলাফল হলো ধর্মহীনতা, ধর্মের সাথে সম্পর্কহীনতা।
সোর্স: ড. আহমদ আলী স্যারের পেইজ থেকে নেয়া।