গণতন্ত্রের অনুশীলন: ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা বনাম ক্ষমতার দৃশ্যপটে অস্তিত্ব ও সম্মানজনক অবস্থান বজায় রাখার সংগ্রাম!!
কারো কারো ধারণা হলো,
প্রচলিত গণতন্ত্রের মাধ্যমে ইসলামী হুকুমত কায়িম করা কোনোক্রমেই সম্ভব নয়। কেননা, গণতান্ত্রিক নির্বাচন ব্যবস্থা বলতে গেলে টাকার খেলা, প্রভাব-প্রতিপত্তির খেলা, ব্যালেট বাক্স ছিনতাইয়ের খেলা, ব্যালেট বাক্সে জাল ভোট ভর্তির খেলা। এ খেলা কোনো ইসলামী আদর্শবাদী লোকেরা খেলতে পারে না। অতএব, তাদের পক্ষে বিজয়ী হওয়া কিংবা জয়লাভ করা- অন্তত সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
আমরা মনে করি,
এ আপত্তিটি যদিও কোনো কোনো দেশে গণতন্ত্র চর্চার অবস্থার নিরিখে সঠিক মনে হলেও গণতন্ত্রের মূল আদর্শ ও লক্ষ্যের ভিত্তিতে তা যুক্তিযুক্ত নয়। আমরা মুসলিম বিশ্বের এমন অনেক দেশ (যেমন সুদান, আলজেরিয়া, মরক্কো, তিউনিসিয়া, তুরস্ক, মিসর ও মধ্যপ্রাচ্যের অধিকাংশ দেশ) সম্পর্কে জানি, যেখানে গণতন্ত্র সঠিকভাবে বিকশিত হতে পারলে অল্প সময়ের মধ্যেই ইসলামী হুকুমত কায়িম হবে।
তাই এসব দেশে যাতে ইসলামী হুকুমত কায়িম হতে না পারে, এ কারণে মুসলিম বিদ্বেষী বিশ্বমোড়লরা সেসব দেশে গণতন্ত্রের চর্চাকে নানা উপায়ে বাধাগ্রস্ত করে চলছে।
মূল কথা হলো-
বর্তমান গণতান্ত্রিক নির্বাচন ব্যবস্থা ইসলামী হুকুমত কায়িমের জন্য বড় বাধা নয়। ইসলামী হুকুমত কায়িমের জন্য সবচেয়ে বড় প্রয়োজন হলো, ইসলামী হুকুমাতের পক্ষে সুষ্ঠু জনমত তৈরি করা। আর এ জন্য ইসলামপন্থীদেরকে জনমত সৃষ্টির যুগোপযোগী মাধ্যমগুলোর সর্বোচ্চ ব্যবহার করে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে ইসলামী শাসন ব্যবস্থার পক্ষে নিয়ে আসতে হবে।
যে দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী ইসলামী হুকুমত কামনা করবে, তাতে গণতান্ত্রিক নির্বাচন ব্যবস্থা ইসলামী হুকুমত কায়িম করার পথকে বাধাগ্রস্ত তো করবেই না; বরং অধিকতর প্রশস্ত ও সুগম করে দেবে। জনমতের বিরুদ্ধে গিয়ে যে কোনোভাবে জোরজবরদস্তিমূলক ইসলামী হুকুমত কায়িমের প্রয়াস- এটা ইসলামও সমর্থন করে না। তদুপরি এভাবে কোনোক্রমে ইসলামী হুকুমত কায়েম করা সম্ভব হলেও বর্তমান বৈশ্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তা টিকিয়ে রাখা একেবারেই সম্ভব নয়।
উল্লেখ্য, বর্তমানে বিশ্ব মোড়লরা আন্তর্জাতিকতাবাদ ও বিশ্বায়নের কঠিন ফাঁদে ফেলে মুসলিম দেশগুলোকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে যেভাবে শাসন-শোষণ করছে, তাদের ওপর নিজেদের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছে, তাতে মুসলিম দেশগুলোতে ইসলামপন্থীদের ক্ষমতায়ন বা ইসলামী হুকুমত কায়িম করা তো দূরের কথা, বরং স্বাধীনভাবে তাদের অস্তিত্ব রক্ষা করাও এখন দুরূহ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এ অবস্থায় বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় বড়ো ধরনের কোনো পরিবর্তন সূচিত না হলে নিকট-ভবিষ্যতে প্রায় সকল দেশেই- গণতন্ত্র বলেন বা অন্য যে কোনো ব্যবস্থা বলেন- কোনো পদ্ধতিতেই ইসলামপন্থীদের পক্ষে- ব্যাপক জনসমর্থন থাকলেও- ক্ষমতায় যাওয়া কঠিন, আবার কোথাও কোনোভাবে গেলেও স্বাধীনভাবে টিকে থাকা অনেক চ্যালিঞ্জিং ব্যাপার, যা মোকাবেলা করার মতো ইসলামী নেতৃত্ব ও মুসলিমমানস আজও মুসলিম দুনিয়ায় খুব একটা গড়ে ওঠেনি।
সুতরাং এ বৈশ্বিক রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রেক্ষিতে গণতান্ত্রিক মুসলিম দেশগুলোতে ইসলামপন্থীদের গণতন্ত্রের চর্চা, গণতান্ত্রিক নির্বাচনে অংশগ্রহণ কেবল ক্ষমতায় যাওয়ার জন্যই নয়; বরং নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা ও অবস্থান উত্তরোত্তর দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর করার উদ্দেশ্যেও হতে পারে।
এরূপ প্রতিকূল রাজনৈতিক অবস্থায় ইসলামপন্থীগণ অন্তত গণতান্ত্রিক নির্বাচন ব্যবস্থায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে -যতটুকু সুযোগ পাওয়া যায় তার যথার্থ ব্যবহার করে- ক্ষমতার দৃশ্যপটে বরাবরই একটি বড়ো প্রেসার গ্রুপ/ইন্টারেস্ট গ্রুপ হিসেবে আবির্ভূত হতে পারেন এবং এ প্রক্রিয়ায় দীন ও মিল্লতের স্বার্থ ও কল্যাণ- যতটা সম্ভব- আদায় করে নিতে পারেন।
পক্ষান্তরে এ অবস্থায় যদি ইসলামপন্থীগণ মোটেরওপর গণতন্ত্রের চর্চা ত্যাগ করেন, নির্বাচন ব্যবস্থা বর্জন করেন, তাহলে অনেক ক্ষেত্রে তারা ক্ষমতার দৃশ্যপট থেকে সম্পূর্ণ হারিয়ে যেতে বাধ্য হবেন এবং এর ফলে ক্রমে তাদের অস্তিত্ব ও স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করা, সম্মানজনক অবস্থান ধরে রাখাও অনেকখানি কঠিন হয়ে যেতে পারে।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এ কথাটি আরও উত্তমভাবে প্রযোজ্য। সমকালীন বৈশ্বিক রাজনীতি ও বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান, বিশেষ করে বর্তমান ভারতের পেটে বসে ইসলামপন্থীদের ক্ষমতায়ন বা ইসলামী হুকুমত/খিলাফত কায়িম করা তো দূরের কথা; বরং স্বাধীনভাবে নিজেদের টিকে থাকা এবং সগর্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোই এখন অনেক কঠিন হয়ে পড়েছে।
এমনকি, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে দেশে ইসলামী শক্তির পক্ষে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার বাইরে গিয়ে কোনো রাষ্ট্র তৈরি করার বা সমহিমায় টিকে থাকার চিন্তা করা যে একটা অপরিণামদর্শী ও অবাস্তব চিন্তা- তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
কাজেই আপাতত ইসলামী দলগুলোকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অগ্রসর হয়ে নিজেদের অবস্থান- যতটা পারা যায়- সুসংহত করার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে, যতদিন না বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক রাজনীতিতে আশানুরূপ কোনোরূপ পরিবর্তন আসে।
তবে এর মানে কখনো এ নয় যে,
আমরা একটি পূর্ণাঙ্গ ইসলামী হুকুমত/খিলাফত কায়েমের প্রচেষ্টা একেবারে ছেড়ে দেবো; বরং সার্বিক পরিস্থিতির প্রতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে সময়োচিত ও বাস্তবসম্মত কর্মসূচি ও পরিকল্পনা নিয়ে আমরা আমাদের লক্ষ্যপানে এগিয়ে যাবো, আমাদের প্রচেষ্টা প্রতিনিয়ত চলতে থাকবে। আল্লাহ তা‘আলা- চাহেন তো- যেকোনো মুহূর্তে অবস্থা পরিবর্তন করে দিতে পারেন!!
আমাদের কেউ কেউ আফগানিস্তানের উদাহরণ টানেন। তাদের কথা হলো- সেখানে যদি বিপ্লবের মাধ্যমে ‘ইমারতে ইসলামিয়্যাহ’ প্রতিষ্ঠা করা যায়, তাহলে বাংলাদেশে বা অন্য দেশগুলোতে পারা যাবে না কেন?!
আমরা মনে করি, আফগানিস্তানের ইতিহাস ও এর ভৌগোলিক অবস্থার সাথে আমাদের ইতিহাস ও ভৌগোলিক অবস্থার ঢের পার্থক্য রয়েছে।
প্রথমত, আফগানরা প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর সাথে লড়াই করে নিজেদের সক্ষমতার অনন্য নজীরস্থাপন করেছেন; এ দীর্ঘ সময় ধরে তারা প্রচুর ত্যাগ স্বীকার করেছেন এবং চরম ধৈর্যের পরীক্ষা দিয়েছেন। বলতে গেলে, এ সময়ের মধ্যে আফগান শিশুরা মায়ের উদর থেকে বের হয়েছে বোমার প্রকট আওয়াজ শুনে, যুদ্ধ-বিগ্রহের মধ্যে দিয়েই তারা বেড়ে ওঠেছে।
এভাবে ক্রমে তারা এক ধরনের অজেয় শক্তিতে পরিণত হন এবং দেশটি পরিচয় লাভ করে ‘সাম্রাজ্যবাদের কবরস্থান’রূপে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও সোভিয়েত ইউনিয়নসহ বিশ্বের সব পরাশক্তি দীর্ঘসময় সামরিক অভিযান পরিচালনার পরও আফগান জনগণকে নিজেদের করতলে আনতে সক্ষম হয়নি এবং শেষাবধি ব্যর্থ হয়ে ফিরে গেছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অ্যাসবি বলেন,
‘‘যদি বস্তুনিষ্ঠভাবে দেখা হয়, আফগানিস্তান একটি কঠিন জায়গা। এটি এমন এক জটিল দেশ, যেখানে অস্থিতিশীল অবকাঠামো, খুব সীমিত উন্নয়ন এবং অঞ্চলটির চারদিকে রয়েছে বিস্তৃত ভূমি। .. সোভিয়েত ইউনিয়ন, ব্রিটেন বা যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানের সঙ্গে কোনো নমনীয়তা দেখায়নি। তারা নিজেদের পথে যেতে চেয়েছিল, অনেকদূর এগিয়েও যায়, কিন্তু তারা কখনও আফগানিস্তানের জটিলতা বুঝতে পারেনি।”
বলতে গেলে আফগানিস্তান বর্তমানে এমন এক অবস্থায় এসে পৌঁছেছে, মনে হয় না যে, এখন অন্য কোনো শক্তি কথিত ওই কবরস্থানে আক্রমণের ঝুঁকি নেবে।
দ্বিতীয়ত, তাদের ভৌগোলিক অবস্থানও আমাদের তুলনায় অনেক সুবিধাজনক; এটি প্রায়ই মুসলিম দেশগুলোর মধ্যস্থলে অবস্থিত, এর সীমানায় রয়েছে ইরান, পাকিস্তান, তাজিকিস্তান, উজবেকিস্তান ও তুর্কমেনিস্তান প্রভৃতি দেশ। ওই সব দেশ থেকে বিভিন্ন সময় তারা নানাভাবে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ও রসদ প্রভৃতি সহযোগিতা পেয়েছে।
তৃতীয়ত, সেখানে জনসংখ্যার প্রায় ৯৯ শতাংশই হলো মুসলিম। ফলে দেশের অভ্যন্তরে সংখ্যালঘু কর্তৃক কোনোরূপ ষড়যন্ত্র তৈরির সম্ভাবনাও ছিল না বললেই চলে।
আমাদের বাংলাদেশের অবস্থা ঠিক বিপরীত। কারণ,
প্রথমত, আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক বৃহৎ শক্তিগুলোর সাথে দীর্ঘ সময় ধরে মোকাবেলা করে টিকে থাকার মতো দৃঢ় মানসিকতাসম্পন্ন ত্যাগী জানবাজ লোক আজও এ দেশে খুব বেশি তৈরি হয়নি।
দ্বিতীয়ত, প্রশ্ন হলো- দীর্ঘ সময় ধরে কোনো বড়ো শক্তির সাথে যুদ্ধ-সংগ্রাম চালিয়ে যাবার মতো প্রয়োজনীয় শক্তি-সামর্থ্য-রসদ-সরঞ্জাম আমাদের কতটা আছে?! ভারত যেভাবে বিভিন্ন দিক থেকে আমাদের বেষ্টন করে রেখেছে সেই অবস্থায় থেকে বাইরের সহযোগিতা পাওয়াও আমাদের জন্য অনেক কঠিন ব্যাপার।
তৃতীয়ত, আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ আজও ইসলামী বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত নয়। তারা ইসলামকে ভালোবাসলেও রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হোক- তা আন্তরিকভাবে কামনা করে না এবং এ কারণে এতদুদ্দেশ্যে বড়ো ধরনের কোনো ত্যাগ স্বীকার করতেও প্রস্তুত নয়।
চতুর্থত, বাংলাদেশ যদিও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক অনন্য ভূমি; তবুও আমাদের পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারত তার স্বার্থে প্রতিনিয়ত সংখ্যালঘুদের একটি শ্রেণিকে দিয়ে নতুন নতুন ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে।
পঞ্চমত, আমাদের ইসলামী শক্তিগুলো সুসংহত ও ঐক্যবদ্ধ নয়। নিজেরা নানা দল-উপদল ও শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত এবং প্রায়ই নিজেদের অভ্যন্তরীণ কলহ-বিবাদে লিপ্ত থাকে। এ অবস্থায় আমাদের জনগণ তাদেরকে কোনোভাবেই রাষ্ট্রপরিচালনায় আস্থায় নিতে পারছে না।
কাজেই প্রত্যেকটি দেশকে তার নিজস্ব ইতিহাস-ঐতিহ্য, শক্তি-সামর্থ্য ও অবস্থান দিয়েই মূল্যায়ন করতে হবে; অন্য দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য, শক্তি-সামর্থ্য ও অবস্থান দিয়েই নয়।