লেখক: ড. আহমদ আলী
আমরা মনে করি, ব্যাংকিং কার্যক্রমে শরীয়া পরিপালন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ব্যাংক নীতিগতভাবে যেসব বিধিব্যবস্থার কথা বলে এবং ম্যানুয়েলে লিপিবদ্ধ আছে তা স্ব স্ব স্থানে সঠিক, যদিও ক্ষেত্রবিশেষে কিছু আপডেটের প্রয়োজন রয়েছে;
কিন্তু বড় আপত্তি হলো- এসব বিধিব্যবস্থার যথার্থ কার্যকারিতা ও সাফল্য নিয়ে। অনেকেই মনে করেন, এসব বিধিব্যবস্থা কাগজে-কলমে থাকলেও সব জায়গায় এবং সর্বক্ষেত্রে এর যথার্থ ও পরিপূর্ণ প্রয়োগ নেই। ফলে ব্যাংকের নানা কার্যক্রমে নিয়মিত শরীয়া লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটে যাচ্ছে, নানা দুর্নীতি হচ্ছে, ব্যাংকের ভেতরকার পরিবেশও দিনের পর দিন কলুষিত হচ্ছে।
নিম্নে আমরা এর প্রধান কয়েকটি কারণ উল্লেখ করছি:
ক. ব্যাংকের শরীয়া ম্যানুয়ালে শরীয়া সুপারভাইজরি কমিটিতে দক্ষ, যোগ্য, সৎ ও ন্যায়পরায়ণ লোকদের নিয়োগের কথা লিপিবদ্ধ থাকলেও কার্যত বিভিন্ন ইসলামী ব্যাংকের শরীয়া সুপারভাইজরি কমিটিগুলোর অধিকাংশ সদস্য ব্যাংকের বাস্তব ব্যবসায়িক কার্যক্রম সম্পর্কে অনভিজ্ঞ, আবার অনেকের শরীয়া বিষয়েও প্রয়োজনীয় যোগ্যতার যথেষ্ট অভাব রয়েছে। আমার জানা মতে, অনেক সদস্য শরীয়া বিষয়ে কোনোরূপ গবেষণা ও কনসেপ্ট দেওয়ার মতো ন্যূনতম যোগ্যতাও রাখে না।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. এম কবীর হাসান বলেন,
‘তবে এ তারল্য সংকটসহ আরো অন্যান্য ব্যাংকিং অনিয়মের পেছনে দুর্বল শরীয়া বোর্ড, ব্যাংক কর্তৃপক্ষের শরীয়া আইনের প্রতি অনীহাও অনেকাংশে কাজ করে থাকে। এক্ষেত্রে ইসলামী ব্যাংকিং বিষয়ে গভীর শরীয়া জ্ঞান রাখেন- এমন গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি ব্যক্তিদের সমন্বয়ে একটি পূর্ণ স্বাধীন শরীয়া বোর্ড থাকলে সেখানে অনিয়মের মাত্রা অনেকাংশেই কমে আসবে বলে আশা করা যায়। বর্তমানের বিভিন্ন ব্যাংকে যারা শরীয়া স্কলার হিসেবে কর্মরত আছেন, দেখা যায় কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া বেশির ভাগই স্বীকৃত ব্যাংকিং শরীয়া স্কলার নন বা ইসলামী ব্যাংকিং নিয়ে তাদের প্রাতিষ্ঠানিক কোনো অধ্যয়ন নেই। ’
কোনো কোনো সমালোচকের মন্তব্য এরূপ যে,
বর্তমানে বাংলাদেশে শরীয়া বোর্ডের কার্যকারিতা বলতে বাস্তবে তেমন কিছু নেই। এখানে শরীয়া বোর্ড গঠন করা হয় একান্তই মানুষের আস্থা অর্জনের জন্য। তাই ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তরীকতের শাইখ, জনপ্রিয় আলিম, টিভি ব্যক্তিত্ব, ধর্মীয় বক্তা, মসজিদের খতীব, কোনো প্রসিদ্ধ মাদরাসার শিক্ষক, অধ্যক্ষ বা মুহতামিম অথবা বিশ্বিবিদ্যালয়ের আরবী বা ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষক প্রমুখ- এরূপ অনেককেই তাদেরকে বোর্ডে নিয়ে আসেন, যাদের অর্থনীতি, ফাইন্যান্স ও ব্যাংকিং প্রভৃতি সম্পর্কে প্রয়োজনীয় বিশেষায়িত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা নেই।
উল্লেখ্য, শরীয়া বোর্ড ইচ্ছা করলে নিয়মিত রুটিন অডিটের অতিরিক্ত বিশেষ অডিট করতে পারেন, সে স্বাধীনতাই তাদের আছে বলে দাবী করা হয় কিন্তু বাংলাদেশে এ যাবত শরীয়া বোর্ড তার এ অধিকার কখনও প্রয়োগ করেছে বলে আমার গবেষণায় খোঁজে পাইনি।
এ প্রসঙ্গে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি-এর সাবেক এএমডি বিশিষ্ট ইসলামী অর্থনীতিবিদ মুহাম্মদ শামসুজ্জামান Zaman Shams তার অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন এভাবে-
‘আমার ব্যাংকিং লাইফে কখনো স্বাধীনভাবে তারা ব্যাংকের বুকস অব একাউন্টস-এ হাত দিয়েছে বলে আমার জানা নেই। উপরন্তু, ম্যানেজমেন্ট-এর প্রতিকুলে যায় এরকম সিদ্ধান্ত তারা কদাচিত নেন।’
খ. ব্যাংকের শরীয়া ম্যানুয়ালে শরীয়া সুপারভাইজরি কমিটিতে সদস্যদের নিয়োগের কিছু নীতিমালা থাকলেও তাঁদের নিয়োগের প্রক্রিয়াটি পুরো স্বচ্ছ ও আইন দ্বারা সুনিয়ন্ত্রিত নয়। ফলে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তাদের ইচ্ছা ও সুবিধামতো যে কাউকে কমিটিতে নিয়োগ দিতে পারে, আবার বাদও দিতে পারে। এ অবস্থায় যোগ্যতা ও নীতিনৈতিকতার দিক থেকে দুর্বল কেউ কেউ যে ব্যাংক কর্তৃপক্ষের সুনজরে থাকার কারণে সুপারভাইজরি কমিটির সদস্য হয়ে যায়, এমনকি কমিটির চেয়ারম্যানও হয়ে যায়- তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
এ অবস্থায় তাঁদের পক্ষে ব্যাংকিং কার্যক্রমে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সম্পূর্ণ প্রভাবমুক্ত হয়ে শরীয়া পরিপালন নিশ্চিত করা, ব্যাংকের যাবতীয় কার্যক্রম পূর্ণ আন্তরিকতা ও সাহস নিয়ে তদারকি করা, এমনকি অনিয়ম বা দুর্নীতি কিছু হলে বাধা দান করা সম্ভবও নয়।
গ. অনুরূপভাবে শরীয়া সেক্রেটারিয়েটের ক্ষেত্রেও ইসলামী শরীয়া সম্পর্কে বিশেষভাবে অভিজ্ঞ ও যোগ্যদের নিয়োগের কথা থাকলেও কার্যত বিভিন্ন ইসলামী ব্যাংকের শরীয়া সেক্রেটারিয়েটে যোগ্য লোকের সংখ্যা খুবই কম। এদের অধিকাংশই শরীয়া বিষয়ে কোনোরূপ গবেষণা ও কনসেপ্ট পেপার প্রস্তুত করার মতো যোগ্যতা রাখে না।
ঘ. শরীয়া অডিট বিভাগের কর্মকর্তাগণ (মুরাকিবগণ) অধিকাংশই পেশাগতভাবে সুদক্ষ নন; তদুপরি তাঁরা ব্যাংকের বেতন ভোগী কর্মকর্তা। তাঁরা কখনই ব্যাংকের মালিক ও পরিচালকদের বিরুদ্ধে ব্যাপক শরীয়া লঙ্ঘন, বড়ো অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপন করার সাহস রাখবেন না_এটাই স্বাভাবিক। তা ছাড়া অনেক ব্যাংকে এ কাজে নিয়োজিত লোকবল এতোই স্বল্প যে, সময়ের অভাবে তাদের পক্ষে ব্যাংকের সকল শাখার সকল বিনিয়োগ ডিল পরখ করে দেখাও সম্ভব হয় না।
(ইসলামী ব্যাংকে শরীয়া-পরিপালন ও লঙ্ঘন: সমস্যা ও উত্তরণভাবনা [প্রকাশিতব্য বই] থেকে)
সোর্স: ড. আহমদ আলী স্যারের পেইজ থেকে নেয়া।
মূল লিংক: এখানে ক্লিক করুন